গ্রামের অন্ধকার আর শহরের অন্ধকার আলাদা। শহরে যেমন ব্যস্ততার মাঝে সন্ধ্যা যেনো একটু একটু করে আসে। গ্রামে অনেকটা ঝুপ করেই সন্ধ্যা নেমে যায়। শহরের অন্ধকারে ভয়ের অনেক কারণ আছে, তার সবই মানবসৃষ্ট। গ্রামের অন্ধকারে এক অলৌকিক, অতিপ্রাকৃত ভয় আছে। হতে পারে তা আমার অপরিচিত বলে, ভয়ের স্বরূপও অযৌক্তিক।
গ্রাম মানেই প্রকৃতির যে চিত্র ভেসে ওঠে, তা একসময় কেনো যেনো আর আপন মনে হয় না। ঐ কংক্রিটের শহরের জন্যই মন কেমন করে। বিভূতিভূষণ যেমন বলেছেন, দেশ না ছাড়লে দেশের জন্য ভালোবাসা বোঝা যায় না। আমার প্রতিদিনের নিস্তরঙ্গ জীবনও আকাঙ্ক্ষিত মনে হয়, কয়েকদিন এর থেকে দূরে থাকলে।
গ্রাম আর শহর চিরকালই ভিন্ন। তাদের জীবনব্যবস্থা, চিন্তাধারা, বিশ্বাস, ভালোবাসা আর ঘৃণা, আগ্রহ আর উদাসীনতা সবই নিজস্ব গতিতে চলে। এর মাঝে একদুইবার ঢু মেরে না আসলে ঠিক বোধগম্য হয়না। তারা যে পরিবর্তিত হয় না বা হচ্ছে না, তা নয়। উন্নয়নের ঢেউ খর পরিবর্তনের জোয়ার সেখানেও এসেছে বৈকি। তাতে কতটুকু উন্নতি আর কতটুকু প্রকৃতির ধ্বংস হয়েছে, বিভূতিবাবুর মতো আমিও খবর রাখি না ঠিক।
কিন্তু একটা বিষয় নতুন দেখলাম, ব্যবধান যে শুধু শহর আর গ্রামের তা নয়। ব্যবধান সেখানে থাকা মানুষের মাঝেও আছে; তা ধর্ম বিশ্বাস হোক, অর্থের ব্যবধান হোক অথবা মনের অমিল। একসাথে দীর্ঘ সময় ধরে পাশাপাশি থাকা মানুষের নব্য সৃষ্ট ব্যবধান, কিছুটা কষ্ট দেয়।
বিভূতিভূষণ কাজের উদ্দেশ্যে বিহারের পাথুরিয়িঘাটা এস্টেটের সহকারী ম্যানেজার হিসাবে ইসমাইলপুর এবং আজমাবাদে ছিলেন। সেখানে পুরো জায়গাটা প্রকৃতি দেবীর আশীর্বাদে পূর্ণ। এক অভূতপূর্ব পরিবেশে তিনি ছিলেন দীর্ঘ সময়। সেখানকার মানুষ এক ভিন্ন জগতেই যেন বাস করে। সাধারণ, মৌলিক চাহিদাগুলো যেখানে পূরণ হতে পারে না; সেখানে যেনো প্রকৃতির সহজ সৌন্দর্য তাদের মনকেও করে তুলেছে নির্মল।
এটা ভ্রমণ কাহিনি নয়, ডায়রিও নয়। নির্ভেজাল পৃথিবীর সহজ, সুন্দর বর্ণনা। যখন অরণ্যের গহীন, ভয়ংকর নিস্তব্ধতায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হবে তখন এই বই পড়বো। বিভূতিভূষণের হাতে প্রকৃতি জীবন্ত হয়ে ওঠে। যখন তা ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হবে, তখন এই পড়বো।
যখন হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হবে, মন কেমনের দিনে যখন বাতাসে পাতার গান শুনতে ইচ্ছে হবে তখন এই বই পড়বো।
আবারও, বারবার।