গল্পের প্রধান চরিত্র শশী ডাক্তার। মন আর মস্তিষ্কের দ্বন্দ্বের যদি কোনো গঠন থাকতো, তা শশীর মতোই দেখতে হতো। শশী দায়িত্ববান, দয়ালু একজন মানুষ। ছোটবেলায় “জীবনের লক্ষ্য” রচনাতে যা লিখতাম, ডাক্তার হয়ে গ্রামের মানুষের সেবা করবো। শশী তা বাস্তবে করে দেখিয়েছে। তাতে যে মনে খুব শান্তি, ব্যাপারটা তা নয়। “আমার এখানে নয়, অন্য কোনো খানে, অন্য কোনো স্থানে থাকা উচিত-” নামক যে রোগে আমরা আক্রান্ত; ডাক্তারবাবুরও সে একই রোগ।
আর আছে, মনের দ্বন্দ্ব। কুসুম না কি মতি, কার প্রতি টান বা ভালোবাসা বেশি এমন অসম্ভব সমীকরণ মিলাতে গিয়ে দেখি; কুসুমের প্রতিই পাল্লা ভারী। কিন্তু, এ তো সমাজ আর রীতি বিরুদ্ধ। কুসুম তো বিবাহিতা। মন আর মস্তিষ্কের এই দোলাচলে শশী কোন দিকে যাবে?
কুসুমের দ্বন্দ্ব নেই, তা নয়। কিন্তু, কুসুমের যেটা আছে তা হলো সাহস। তার অনুভূতি সরল, প্রকাশ দৃঢ়। তাই তো, শশী ভাবে যে “কাঁটা ফুটিবার ভয়ও কি নাই কুসুমের মনে?”
কুসুমের এই সাহসের সাথে পাল্লা দিতে না পেরেই বোধ হয় শশী বলে, “শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?” শরীরই সব নয় তা আমি মানি। তবে, কি না নারীর মুখে শরীরের কথা শুনেই কী শশীর মনের কথা মনে পড়লো? প্রশ্ন রয়ে গেল।
তারপর আছে, শশীর বন্ধু কুমুদ। শশী যদি দ্বন্দ্ব হয়, কুমুদ তবে খেয়ালখুশি। যখন যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে, সাথে আছে দার্শনিক তত্ত্ব। কিশোরী মতিকে বিয়ে করে, তাকে নিজের মতো গড়ে নিতে চায় কুমুদ। কিন্তু, “নিজের মতো গড়িয়ে তোলা মানুষকে কি প্রিয়ার আসনে বসানো যায়?” শশীর এই প্রশ্নের সাথে আমি একমত। সাথে থাকা মানুষটার নিজস্ব সত্ত্বাকে সম্মান করতে না পারলে, ঐসব দেশ উদ্ধার করা বুলি দিয়ে আদৌ কী হবে সেটা আমার বোধগম্য না।
শশী আর কুমুদ মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ হলে, বলতে হয় যে জীবনে একটা সামঞ্জস্য থাকতে হয়। অন্তত, যদি অন্য কাউকে জড়াতে চাই। কিন্তু যতো তত্ত্ব আর পথই বের করি না কেন, সুতো তো আমাদের হাতে নেই। কুসুমের বাবা অনন্ত যখন বলে,”সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর।…পুতুল বৈ তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।” বইয়ের নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ হয় বৈকি।
বিন্দু আর নন্দের সম্পর্কের মাঝে ফ্রয়েড, গ্রামের মানুষের কষ্টের মাঝে মার্কসবাদ বা শ্রেণি বৈষম্য এসেছে। তবে তা গল্পের প্রয়োজনে। লেখক এখানে ভাগ্যের কাছে মানুষের অসহায়তা অথবা যুক্তি আর অনুভূতির দ্বন্দ্বই দেখাতে চেয়েছেন বলে আমার বেশি মনে হয়েছে।